ঢাকা , শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫ , ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
সরকার সংস্কার কমিশন করলেও নদীর ক্ষেত্রে প্রতিফলন নেই-আনু মুহাম্মদ বাড্ডায় কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে নিহত ১ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বিপুল খরচেও কমানো যাচ্ছে না নানামুখী আতঙ্ক রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা সেই শিশু আছিয়া না ফেরার দেশে ধর্ষণে আতঙ্ক -উদ্বেগ ভারতকে অযাচিত বিভ্রান্তিকর মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে বলল ঢাকা প্রধান উপদেষ্টা চীন সফরে যাচ্ছেন ২৬ মার্চ সালমান এফ রহমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা খরায় পুড়ছে চা-বাগান উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা ইফতারিতে দই-চিড়ার জাদু একরাতে দু’জনকে কুপিয়ে হত্যা এলাকায় আতঙ্ক স্বাভাবিক নিত্যপণ্যের বাজার, সংকট সয়াবিনে মামলা থেকে স্বামীর নাম বাদ দেয়ার কথা বলে স্ত্রীকে ধর্ষণ ছেঁউড়িয়ায় শুরু লালন স্মরণোৎসব দোহাজারীতে বাসচাপায় ৩ জন নিহত হেনস্তার পর ছাত্রীকে ফেলে দিলো দুর্বৃত্তরা ৫৬০ মডেল মসজিদ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ভ্যাট দেয় না বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরনের কাপড় টিভি ফ্রিজ খাট টাকা সব পুড়ে শেষ বস্তিতে আগুন
* সুনামগঞ্জে আশ্রয়কেন্দ্রে বাড়ছে বানভাসি মানুষ * সিলেটে বন্যার পানি কোথাও কমছে কোথাও বাড়ছে * বন্যার্তদের সহায়তায় আনসার বাহিনী * কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ওপরে তিস্তা ধরলাসহ ১৬ নদীর পানি

বন্যার পানিতে থৈ থৈ সুনামগঞ্জ

  • আপলোড সময় : ২০-০৬-২০২৪ ১০:৩৭:১৩ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২১-০৬-২০২৪ ০৩:২১:০১ পূর্বাহ্ন
বন্যার পানিতে থৈ থৈ সুনামগঞ্জ সিলেটে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে দুর্ভোগ কমেনি মানুষের। ছবিটি গতকাল বৃহস্পতিবার সিলেট নগরীর তালতলা পয়েন্ট থেকে তোলা
বন্যার পানিতে থৈ থৈ সুনামগঞ্জের আশপাশের সব এলাকা। ডুবে আছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। যে সড়কে দাপিয়ে বেড়িয়েছে অটোরিকশা, রিকশাসহ সব মোটরযান সেই সাথে চলছে নৌকা। এদিকে সিলেটে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমায় প্লাবিত এলাকার পানি কিছুটা কমলেও জেলার কোথাও কোথাও অবনতি হয়েছে। এখনও ভারত থেকে নেমে আসা উজানের পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেটের প্রধান নদী সুরমা-কুশিয়ারার পানি ছয়টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে কুড়িগ্রামে তিস্তা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা নদীসহ ১৬টি নদীর পানি বেড়েই চলেছে। এরমধ্যে ধরলা ও তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তিন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। ঢাকা থেকে বন্যার সার্বিক পরিস্থিত পর্যবেক্ষণ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিন। সংশ্লিষ্ট সকল দফতরকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। একই সাথে কোন প্রকার গাফিলতি যাতে না হয় সে দিকেও খেয়াল রাখতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  জানা গেছে, সিলেট নগরীর তালতলা, জামতলা, মাছুদিঘীরপাড়, উপশহর, যতরপুর, সোবাহানীঘাট, মীরাবাজার, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, তোপখানা, বেতেরবাজার এলাকার রাস্তাঘাটে হাঁটু সমান পানি রয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, পানি আগের থেকে কিছুটা কমেছে। তবে বৃষ্টি শুরু হলে আবার বেড়ে যাবে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে, সিলেটের প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারার ছয়টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। আর গোয়াইনঘাটের সারি নদীর পানি সকাল থেকে বিপদসীমার নিচে রয়েছে।  পানির উচ্চতা কিছুটা নিচে নেমেছে। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কোথাও পানি কমেছে, আবার কোথাও বেড়েছে। তবে কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্ট ছাড়া অন্য নদ-নদীগুলোর পানি আগের তুলনায় নেমেছে। বন্যার্ত এলাকায় প্রশাসনের ত্রাণ বিরতণ অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির ওপর সর্তক দৃষ্টি রাখছে। সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকার বাসিন্দা ও সংবাদকর্মী শাহিদ হাতিমী বলেন, আমার উপজেলার কিছু মানুষের বাড়িঘর থেকে পানি নেমেছে। তবে বেশিরভাগ এলাকায় রাস্তাঘাট ও বাসাবাড়িতে এখনও বন্যার পানি রয়েছে। আমি সিলেট শহরে বাসা নিয়ে থাকি। ঈদের আগেরদিন এলাকায় এসেছিলাম। গিয়ে দেখি আমার বাসার আসবাবপত্রসহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিস পানিতে তলিয়ে গেছে। সিলেট নগরীর উপশহরের ডি ব্লকের বাসিন্দা আহমেদ চৌধুরী বলেন, ঈদের দিন বাসার নিচ তলায় পানি প্রবেশ করেছিল। পানির জন্য ঠিকমত ঈদের আনুষ্ঠিকতা করা হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবারও বাসায় পানি রয়েছে। বন্দির মতো দিনকাল যাচ্ছে, তবে পানি একটু কমছে। গত বুধবার বিকাল পর্যন্ত সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, মহানগরীর ২৩টি ওয়ার্ড ও জেলার ১০৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে ৮ লাখ ২৫ হাজার ২৫৬ জন মানুষ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সিলেট জেলা-নগর মিলিয়ে ৬৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে মহানগরে ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৯ হাজার ৯৫৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছে। উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নের ২২৩ টি গ্রামের ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ জন মানুষ বন্যা কবলিত। তার মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে ১ হাজার ৪৪০ জন মানুষ। উপজেলার প্রধান প্রধান সড়ক ডুবে যাওয়ায় সিলেট জেলার সাথে গোয়াইনঘাট উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ১১৩টি গ্রামের ৯৫ হাজার ৫০০ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন ৭ হাজার ৩০৩ জন। উপজেলার বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক বাদে বাকি সকল সড়ক পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। যার কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজন নৌকা ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে পারতেছে না।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, সিলেটে বৃষ্টিপাত কম হওয়া ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতেও বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসায় নদ-নদীর পানি কিছুটা কমেছে। ভারতের মেঘালয়ে বৃষ্টির ওপর বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির বিষয়টি নির্ভর করছে। পাহাড়ি ঢল নামার ফলে নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সিলেট আবহাওয়া অধিদফতরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১১০ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে বুধবার রাতে কোনো বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়নি। সিলেটে আগামী দুই দিন মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। ব্যাপক বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বানভাসি এসব মানুষের উদ্ধার করে নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা, তাদের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিতসহ সার্বিক সহযোগিতায় নিরলসভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বাহিনীটি জানায়, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুনামগঞ্জ জেলা কমান্ড্যান্ট কার্যালয়ের প্রশিক্ষণ ব্যারাক, ডাইনিং রুম ও হল রুমে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন ৫১০ জন। স্থানীয় প্রশাসন ও বাহিনীর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তাদের যাবতীয় প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হচ্ছে। সুনামগঞ্জ জেলার স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ৬০টি আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন আনসার-ভিডিপি সদস্য-সদস্যারা।
অপরদিকে সিলেট জেলার ৪৭১টি আশ্রয়কেন্দ্রের প্রতিটিতে পাঁচজন করে আনসার-ভিডিপি সদস্য নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করছেন। তাছাড়া এ জেলার জৈন্তাপুর, কোম্পানিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও সদর উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রের ৫৫০ পরিবারকে জেলা আনসার ও ভিডিপির পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বাহিনীর সদর দফতরের নির্দেশনা মোতাবেক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।সবাইকে বন্যা মোকাবিলায় অকৃত্রিমভাবে কাজ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ কমান্ডার ও জেলা কমান্ড্যান্টরা ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড দলনেতা-দলনেত্রী, উপজেলা ও ইউনিয়ন আনসার কমান্ডার ও সহকারী আনসার কমান্ডারদের বন্যা মোকাবিলায় শুরু থেকেই সম্পৃক্ত করেছেন। তারা সম্মিলিতভাবে বন্যা দুর্গতদের তাদের গবাদি পশু ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তিসহ নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরে সহায়তা করছেন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছেন। বন্যায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মানুষদের নৌকা কিংবা ভেলা দিয়ে তাদের পরিবার-পরিজনসহ আনসার-ভিডিপি সদস্যরা নিয়ে আসছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। বন্যা দুর্গতদের জন্য বিভিন্ন সরকারি অফিস, স্থানীয় প্রশাসন ও এনজিওদের খাদ্য বিতরণ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে সহায়তা করছে আনসার-ভিডিপি সদস্য-সদস্যারা। নিজস্ব অর্থায়নেও তারা দুর্গতদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করছেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি বন্যার কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মানুষদের নৌকায় করে খিচুড়ি, শুকনো খাবার ও পানিবাহিত রোগ মোকাবিলায় ওষুধ ও খাবার স্যালাইন পৌঁছে দিচ্ছেন বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সদস্য-সদস্যরা। এদিকে বানের পানিতে থৈ থৈ সুনামগঞ্জের আশপাশের সব এলাকা। ডুবে আছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। যে সড়ক দাপিয়ে বেড়িয়েছি অটোরিকশা, রিকশাসহ সব মোটরযান আজ সেই রাস্তায় চলছে নৌকা। যাদেরকে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে তারা ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। নিম্নআয়ের মানুষ, দিনমজুররা আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে, আর যাদের অবস্থা কিছুটা ভালো তারা উঠেছেন আবাসিক হোটেলে। কেউ কেউ আছেন প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের বাসায়। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলার চারটি পৌরসভা এলাকাসহ ৭৮টি ইউনিয়নের ১ হাজার ১৮টি গ্রামের ছয় লাখ ৬০ হাজার মানুষ বন্যা পরিস্থিতির শিকার।
সুনামগঞ্জ জেলার পুরোটাই বন্যাকবলিত হলেও সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জ সদর, দোয়ারাবাজার, মধ্যনগর ও ছাতক উপজেলার মানুষ। ছাতক উপজেলার পৌরসভাসহ সকল ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নদীর পানি হাওরে প্রবেশ করার কারণে সুনামগঞ্জের অনেক হাওর এখন পানিতে টইটুম্বুর। আর এর ফলে নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে সুনামগঞ্জ সদর, মধ্যনগর, ধর্মপাশা ও শাল্লা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম। ইতোমধ্যে মধ্যনগর ও ধর্মপাশা উপজেলার ৭ হেক্টর জমির সবজিখেত পানিতে নষ্ট হয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলার কায়েতকান্দা, রাজধরপুর, কাকিয়াম মৌলভীপাড়া, আলমপুর দোয়াদুর রহমান ও দক্ষিণ রূপনগরের মোট পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বন্যায় তলিয়ে আছে সকল উপজেলার স্থানীয় সড়ক। জেলা শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, মধ্যনগর এবং ছাতক উপজেলার।
লবজান চৌধুরী উচ্চ বালিকা কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া লতিফুন্নেছা বলেন, আমার ঘরের ভেতর গলা সমান পানি। ঘরে ছেলে বউ আর এক আট বছরের এক নাতি ছিল। ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টসের চাকরি করে। পানি যখন ঘরে প্রবেশ করতে শুরু করে আমি আমার নাতি আর বউকে নিয়ে এখানে চলে আসি। সাথে নিয়ে এসেছি দুটি বালিশ আর একটা কম্বল। ঘরে তালা দেওয়ার সময়ও পাইনি। একই আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক সাইফুল ইসলাম বলেন, খুব কষ্টে আছি ভাই। তিন দিন ধরে কাজে যাই না। বউ, ছেলে-মেয়ে না খেয়ে আছে। ১ কেজি চাল আর ২০০ গ্রাম ডাল এনেছিলাম। খেয়ে শেষ হয়ে গেছে। এখন কেউ দিলে খাই আর না হয় খালি পেটে থাকি। বাচ্চাদের জন্য বিস্কুট নিয়ে এসেছি। কিন্তু আমার বাচ্চারা ভাত খাবে বলে আবদার করছে। বড়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া রফিকুল বলেন, আমাদের পরিবারের সদস্য ৯ জন। আমরা দুই আশ্রয়কেন্দ্রে মিলিয়ে থাকছি। দিনের অর্ধেক সময় এখানে বাকি সময় লবজান চৌধুরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে কাটে। আমাদের দিকে আল্লাহ কবে যে সুনজর দেবেন তা তিনিই ভালো জানেন। আমাদের আর এই কষ্ট সহ্য হচ্ছে না।
সেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ আম্মার বলেন, ২০২২ এর বন্যায় আমরা দেখেছি বন্যা কতটা ভয়াবহ রুপ নিতে পারে। আর সেই ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ৫-৭ জনের টিম করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। অনেকে আমাদের কাছে ফোন দিয়ে জরুরি ঔষুধ এবং খাবার চাচ্ছেন। আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী সুনামগঞ্জ জেলার ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ১৮ হাজার ৪২৯ জন বন্যা আক্রান্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সুনামগঞ্জের বন্যা আক্রান্ত মানুষের পাশে প্রশাসনের পাশাপাশি কাজ করছেন জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, সুরমা নদীর পানি কোনো কোনো স্থানে সামান্য কমেছে আবার কোন স্থানে বাড়ছে। তবে আগামী ৪৮ ঘণ্টা ভারী, অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই পানি আরও বাড়তে পারে। যদি উজানে বেশি বৃষ্টি হয়, তাহলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের পর্যবেক্ষণে আছে। পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী আছে।আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনা খাবার, রান্না করা খাবার বিতরণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অপরদিকে, কুড়িগ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ফুলবাড়ি উপজেলার তালুকশিমুল শেখ হাসিনা দ্বিতীয় ধরলা সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া রেল সেতু পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। বন্যার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ভাঙন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্যমতে, নদীর পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ভেঙে পড়েছে এসব এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন সড়ক। ডুবে গেছে সবজিসহ বিভিন্ন উঠতি ফসলের ক্ষেত। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানান, পানি বাড়ার কারণে বিভিন্ন জায়গায় প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় ৫-৬টি পয়েন্টে ভাঙন চলছে। সেখানে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা হচ্ছে। তবে স্বল্পমেয়াদি এই বন্যা পরিস্থিতি দু-একদিনের মধ্যে উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
শুলকুর বাজার এলাকার কৃষক রাজু আহমেদ বলেন, বন্যায় পটোল ক্ষেতে পানি উঠেছে। ধানক্ষেত তলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে চলাফেরা করতে সমস্যা হচ্ছে। এভাবে পানি বাড়লে ঘরের মধ্যে বানের পানি চলে আসবে। চরের বাসিন্দা মারুফা বেগম বলেন, পরশু রাত ৩টার দিকে বাড়ির চারদিকে পানি চলে আসে। ওই রাতে আশপাশের লোক ডেকে চারটা ঘর সরিয়ে খোলা মাঠে রেখেছি। বন্যার সময়টা আমাদের কষ্টের সীমা থাকে না। কুড়িগ্রাম কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, চলতি বন্যায় জেলায় ৪৫৩ হেক্টর ফসলি জমি নিমজ্জিত হয়েছে। এরমধ্যে মরিচ, আউশ ধান, পাট, পটোলসহ অন্যান্য ফসল রয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, জেলার ওপর দিয়ে ১৬টি নদী প্রবাহমান। এরমধ্যে ধরলা ও তিস্তার দুটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে রাজারহাট, নাগেশ্বরী ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার নিচু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সহায়তা হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে ১৪৪ টন চাল ও নগদ ১০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ত্রাণ হিসেবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ৪০৪টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে দুর্গত মানুষ আশ্রয় নেয়া শুরু করেছেন। তিনি আরও বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। বন্যার্তদের উদ্ধারে চারটি স্পিডবোট ও দুটি নৌকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। গতকাল বৃহস্পতিবার যাত্রাপুর ও পাঁচগাছি ইউনিয়নের বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন কুড়িগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য ডা. হামিদুল হক খন্দকার। তনি বলেন, বন্যার্তদের সহায়তা দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নদীভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স